আভিজাত্যে রাজকীয় পোশাক জামদানি

জামদানি!

প্রাচীনকালে তাঁত বুনন প্রক্রিয়ায় কার্পাশ তুলার সুতা দিয়ে মসলিন নামে সূক্ষ্ম চিকন সুতার কাপড় তৈরি হতো এবং এই মসলিনের উপর যে জ্যামিতিক নকশাদার বা বুটিদার কাপড় বোনা হতো তারই নাম জামদানি।

jamdani

ফারসি শব্দ “জামা”  মানে কাপড়, “দানা”অর্থ বুটি; অর্থাৎ জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড়। সম্ভবত মুসলমানরাই জামদানির প্রচলন করেন এবং দীর্ঘদিন তাদের হাতেই এ শিল্প একচেটিয়াভাবে সীমাবদ্ধ থাকে। ফারসি

 থেকেই জামদানি নামের উৎপত্তি বলে অনুমান করা হয়। ধারণা করা হয় মুসলমানরাই ভারতীয় মহাদেশে প্রথম জামদানির প্রচলন করেছিলেন। আরেক দলের মতে, ফারসিতে জাম অর্থ এক ধরনের উৎকৃষ্ট মদ এবং দানি অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি ঘটেছে।

jamdani

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম দশক থেকে বাংলায় সূক্ষ্ম মিহি কাপড় সমাদৃত হয়ে আসছিল। বাংলার কার্পাস বা কাঁপাশ বস্ত্রের বিকাশ ঘটেছে অনেক বিবর্তনের মাধ্যমে। বাংলায়  বস্ত্রশিল্প এর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে (আনু. ৩০০ খ্রি)।  সেখানে বঙ্গ ও পুন্ড্র এলাকায় তৈরি সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে। বঙ্গ ও পুন্ড্রতে চার প্রকার বস্ত্রের প্রচলন ছিল: ক্ষৌম, দুকূল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসী।

দুকূল নামের বস্ত্রের ক্রমবিবর্তনই মসলিন। জামদানি নকশার প্রচলন ও মসলিনের বিকাশ পাশাপাশি শুরু হয়েছিল মনে হয়।

মুঘল ইতিহাসে জামদানি

উৎকৃষ্ট ধরনের জামদানি ও মসলিন তৈরির জন্য ঢাকা,  সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, জঙ্গলবাড়ি, বাজিতপুর প্রসিদ্ধ ছিল। ইউরোপীয়রা ছাড়া ইরানি, আর্মেনিয়ান, মুগল, পাঠান বণিকরা এসব ঢাকাই মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ে উৎসাহী ছিলেন। মুগল সম্রাট, বাংলার নবাব ও অন্যান্যদের ব্যবহারের জন্য উৎকৃষ্ট মসলিন ও জামদানি সংগ্রহের জন্য ঢাকায় তাদের গোমস্তা নিযুক্ত ছিল। মুঘল আমল ছিলো ঢাকাই জামদানির স্বর্নযুগ । এ সময়ে শুধু যে মসলিন ও জামদানি শিল্পের উন্নতি হয় তা নয়, দেশে-বিদেশে জামদানি ও মসলিনের চাহিদাও তখন থেকেই বাড়তে থাকে। আঠারো শতকের ইংরেজ কোম্পানির দলিলে দেখা যায় যে, মলমল খাস (mulmul khas) ও সরকার-ই-আলি নামক মসলিন সংগ্রহ করার জন্য ঢাকায় একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর উপাধি ছিল দারোগা-ই-মলমল।

mughal-jamdani

প্রত্যেক তাঁতখানায় একটি করে দপ্তর ছিল এবং সেখানে  আড়ং ( গ্রামীন মেলা)-এর অত্যন্ত নিপুণ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার ইত্যাদি কারিগরের নাম তালিকাবদ্ধ করে রাখা হতো। তাঁতখানায় তাঁতিদের কোনো নির্ধারিত বেতন ছিল না। তারা যতখানি মসলিন বা জামদানি তৈরি করত ঠিক তাঁর বাজার মূল্য দেওয়ার নিয়ম ছিল। দারোগার প্রধান কাজ ছিল মসলিন বা জামদানি তৈরির প্রতি পদক্ষেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা। এভাবে ঢাকা, সোনারগাঁও, জঙ্গলবাড়ি ইত্যাদি থেকে প্রায় প্রতিবছর এক লক্ষ টাকা মূল্যের মলমল-খাস মুগল দরবারে পাঠানো হতো।

১৭৪৭ সালের এক হিসাব অনুযায়ী দিল্লির বাদশাহ, বাংলার নবাব এবং জগৎ শেঠের জন্য সর্বমোট সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার জামদানি কেনা হয়। একই বছর ইউরোপীয় বণিক ও কোম্পানিরা মোট সাড়ে নয় লক্ষ টাকার মসলিন ক্রয় করে। আঠারো শতকের শেষের দিকে মসলিনের রপ্তানি অনেক কমে যায়।

১৭৮৭ সালে James Wise-এর মতে ৫০ লক্ষ টাকা, James Tayler-এর মতে ৩০ লক্ষ টাকার ঢাকাই মসলিন ইংল্যান্ডে রপ্তানি হয়েছিল। ১৮০৭ সালে রপ্তানির পরিমাণ ৮.৫ লক্ষ টাকায় নেমে আসে এবং ১৮১৭ সালে রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমে ইউরোপে মসলিন প্রেরণ করা হতো।

ঐতিহাসিক টেলরের জামদানির বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনানুসারে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর আমলে ১০*২ হাত মাপের ও ৫ শিক্কা ওজনের একটুকরা আব-ই-রওয়ান এর দাম ছিল ৪০০ টাকা। সম্রাট আওরঙজেবের জন্য তৈরি জামদানির দাম ছিল ২৫০ টাকা। ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের জামদানির মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা।

ব্যয়বহুল জামদানির উৎপাদন একচেটিয়াভাবে বহুকাল মুগলদের হাতেই ছিল।

mughal-jamdani

ঢাকায় সদর মলমল খাস কুটির দারোগা জামদানি তৈরির জন্য তাঁতিদের দাদন দিয়ে জামদানি বুননে নিয়োগ করা হতো। এভাবে উৎপাদিত জামদানির মূল্য অনেক বেশি হতো। রাজ শ্রেণীর জন্য উচ্চমূল্যের জামদানি প্রস্তুত হতো রাজকীয় কারখানায়। অভিজাত ধনীরাও নিজেদের ব্যবহার্য জামদানি প্রস্তুতের জন্য উচ্চমূল্যের কারিগর নিয়োগ করতেন।

mughal-jamdani

বিশ্ববাজারেও এসব বহুমূল্য জামদানির ব্যাপক চাহিদা ছিল। এশিয়া ও ইউরোপের রাজন্যবর্গ প্রায়শ ঢাকাই জামদানির জন্য বিভিন্ন বণিক কোম্পানিকে অর্ডার দিতেন। তাই বলা যায় আঠারো শতকের দিকে জামদানি ছিলো শুধুই এ দেশীয় রাজকীয়, অভিজাত, জমিদার ও বণিক ব্যাক্তিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই আজ যখন নিজের গায়ে একখান জামদানি কাপড় জড়াবেন একটা বারের জন্য হলেও মনে হবে সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর কোন রাজ পরিবারের সদস্য আপনি!

mughal-jamdani

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *