উনিশ শতকে জামদানি আর জামদানি গ্রাম

গত পর্বে জেনেছিলাম জামদানির ১৭শতক ও ১৮ শতকের ইতিহাস৷ এরপর উনিশ শতকের প্রথমদিক থেকে উচ্চমূল্যের জামদানি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। তখন স্বল্পদামের মিলের কাপড় বিশ্ববাজার দখল করে নেয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জামদানি মসলিনের এক হিসাবে দেখা যায়, সাদা জমিনবিশিষ্ট কাপড়ের উপর ফুল করা ৫০,০০০ টাকার মূল্যমানের জামদানি মসলিন দিল্লি, লখনৌতি, নেপাল, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি এলাকার নবাব-বাদশাহরা ব্যবহার করতেন। এ মসলিন সাধারণত ঢাকার কাটা সুতা দ্বারা তৈরি হতো।

jamdani-in-nineteenth-century

উনিশ শতকের মাঝামাঝি জামদানি ও মসলিন শিল্প সংকুচিত হওয়ার পিছনে কতিপয় কারণ কাজ করেছিল। প্রথমত, বিলাতে বস্ত্রশিল্পে মেশিন ব্যবহার, দ্বিতীয়ত, বিলাতি সস্তা সুতা আমদানি এবং তৃতীয়ত, তাঁতিদের প্রতি মুঘল বাদশাহ ও তাদের অমাত্যবর্গের অমনোযোগ।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জামদানি কিছুটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ঢাকার অদূরে ডেমরায়-য় জামদানি পল্লীর তাঁতিরা কিছুটা আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন। তবে মেধা ও শিল্পের সঠিক পারিশ্রমিক না পাওয়ায় অন্যান্য অঞ্চলের তাঁতিরা ইদানীং এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে উৎসাহ বোধ করছেন না।কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার মাধুরাপুর গ্রামের অচল তাঁতগুলি তাঁর নীরব সাক্ষী। অথচ এখানেই এক সময় সূক্ষ্ম মিহি কাপড় থেকে শুরু করে ১০০/৩০০ কাউন্টের সুতার চাদর ও নকশি কাপড় অর্থাৎ জামদানি তৈরি হতো। জামদানি শিল্পখ্যাত কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িরও একই দশা।

jamdani-count

বহু বাধা অতিক্রম করে জামদানি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তাঁর ঐতিহ্য রক্ষা করে টিকে আছে। বর্তমানে এর প্রধান সমস্যা, তাঁতশিল্পীরা সঠিক পারিশ্রমিক পান না। একটি ভাল জামদানি শাড়ি তৈরি করতে তাদের এক থেকে দুই মাস সময় লেগে যায়। সে তুলনায় তারা মজুরি পান খুব কম।

jamdani-weaving

জামদানি পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা সময়ে তৈরির করা হলেও বংশানুক্রমিক শৈল্পিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন কারিগর/স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঁচামাল, শীতলক্ষ্যার পানি থেকে উত্থিত বাষ্প সুতা প্রস্ত্ততি ও কাপড় বুনার জন্য সহায়ক বিধায় ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো ইউনিয়নের ১৪টি গ্রাম ও সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়নের ১টি গ্রাম মোট ১৫টি গ্রামে মূলত জামদানি শিল্প কেন্দ্রীভূত। গ্রামগুলি হলো: নোয়াপাড়া, দক্ষিণ রূপসী, রূপসী কাজীপাড়া, গন্দবপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ, মুগুরাকুল, খিদিরপুর, ইমকলী, তারাবো, খালপাড়া, দিঘবরার, খাদুন, পবনকুল ও সুলতানবাগ। তাছাড়া গঙ্গানগর, কাহিনা, মীরগদাই, মাহিমপুর, হরিণা নদীর পাড়, মীরকুটিরছেও ও সোনারগাঁওয়ের কিছু কিছু এলাকায় জামদানি তৈরি হয়। বর্তমানে বোয়ালমারী উপজেলায় উন্নতমানের জামদানি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে।

jamdani-handloom

এই জামদানি শতাব্দি ধরে মানুষের মন জয় করে আসছে এর নকশায়, বুননে আর ধরনে।

আমাদের ২ পর্বের ব্লগে জামদানির ইতিহাস পড়ার পর এই জামদানি কে রাজকীয় পোশাক হিসাবে বলা যায় কি??  😀

শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে রাজ রাজরাদের বস্ত্র টাই-  ভিন্ন ঢং এ ভিন্ন মাত্রায় সেই একই বুনন শৈলী আর সেই নকশাতেই আমাদের কাছে নতুন রুপে এসেছে!

এ যেনো কয়েক শতাব্দির ইতিহাস, আভিজাত্য, গৌরব আর সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারন করা! জামদানি শুধু মাত্র বস্ত্র নয়। এ আমাদের ৩০০ বছরের ও পুরোনো ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি! আমাদের পরিচয়! 🙂