জামদানী নিয়ে যত কথা

আগের ব্লগ পোস্ট গুলোতে জামদানীর উৎস সম্পর্কে জেনেছিলাম। এবার জানবো জামদানীর সুতা সম্পর্কে। 
জামদানিতে মূলত ২ ধরনের সুতা ব্যাবহার হয়। ১. কটন২. সিল্কএখন এই সুতা গুলো দিয়ে তৈরী হয় ৩ রকম জামদানী।

(ক) ফুল কটন জামদানীঃ  ( Most of the exclusive jamdani কটনে হয়। যার রেঞ্জে ৫০০০ থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। যার তানা বাইনের সুতা ( লম্বা লম্বি ও আড়া আড়ি সুতা) কটন হয়। ১০০ এর উপরে আড়ং যে জামদানী করেছিলো সেগুলা ২০০/২২০ কাউন্ট এর ছিলো। সেগুলাকে খাদী জামদানী বলা হয়। 
(খ) হাফসিল্ক জামদানীঃ তানা মানে লম্বালম্বি সুতা হয় কটনের। আর বাইনের সুতা ( আড়া আড়ি ভাবে)  হয় রেশম সিল্কের। 
(গ) ফুল সিল্ক জামদানীঃ যার তানা বাইন অর্থাৎ লম্বা আড়া আড়ি দুই দিকের সুতাই হয় সিল্কের। 
এখন হাফসিল্ক জামদানী অনেক বেশি চলে! কারন সিল্ক সুতার কারনে কাপড়ে উজ্জ্বল্য বাড়ে। চকচকে লাগে। সিল্ক সুতার কারনে কাপড় টাও ওজন কম হয়। 
যদি ও জামদানী এবং ঢাকাই মসলিনের মুল হলো কটন বা তুলার সুতা। 

এবার একটু পিছে ফিরে এর ইতিহাস জানা যাক… 
ইতিহাস কি বলেঃ মসলিনের একটা জাত হলো জামদানী। মসলিন তৈরী হতো কটন দিয়ে। মসলিনের কাউন্ট হলো ৫০০ কাউন্ট অথবা তার ও বেশি। আর ৩০০ কাউন্ট হলো জামদানীর। কয়েকশ বছর আগেও ১৮ শতকের দিকে ৩০০ কাউন্টের জামদানী হতো 😇
আর জামদানী সিল্কের প্রচলন মূলত শুরু করে উনিশ শতকের শুরুতে নবাব সলিমুল্লাহ ও তার স্ত্রী জানাত আরা বেগম। জানাত আরা বেগম সিল্ক ও তুলার যৌথ সমন্বয়ে শাড়ি তৈরির কৌশল ও ধারনা দেন। আর সেই সময়েই সাদা ধুসর জামদানীর পরিবর্তে লাল কালো রঙের প্রচলন শুরু হয়। 
মসলিন এবং জামদানী একদম জন্ম লগ্ন থেকেই অত্যন্ত উচ্চমুল্যের উচ্চমানের। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের সময় হাতে কাটা সুতার প্রচলন, সমগ্র তাত শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ১৭৭০ এর দুর্ভিক্ষের পর থেকে এই শিল্প মুখ থুবরে পড়া শুরু করে। বিশেষ করে মসলিন। পুরো অষ্টাদশ শতাব্দী তে কলের বা মেশিনের সুতা আবিষ্কার হওয়া আর তা তুলনামুলক দাম কম হওয়ায় জমিদার গন ও মসলিন থেকে বিমুখ হন। ব্রিটিশ শিল্পনীতি ও ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন এই শিল্প ধ্বংসের মুখে ঠেলে।দিলে স্থানীয় তাতীরা ” মসলিন”  পরিবর্তে “জামদানী” তে মনোনিবেশ করে। এক্ষেত্রে নবাব সলিমুল্লাহ আর তার স্ত্রীর ভুমিকা ছিলো অসামান্য! উনিশ শতকের শেষে এসে কটন আর সিল্ক যৌগে মিশ্রিত হাফসিল্ক শাড়ির প্রচলন শুরু হয়। সে সময় সোনা ও রুপার সুতা ও ব্যাবহৃত হতো জামদানী তে।
#নাইলনের_সূত্রপাতঃ কালে কালে জামদানীর রঙ আর সুতায় বৈচিত্র এসেছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এসে জামদানী তে আসে নাইলন সুতা। শুধু মাত্র জামদানীর উচ্চমুল্যের কারনে। এটা আসলেই দোষের না। রেশম সিল্ক আর তুলায় বোনা জামদানীর যে দাম তাকে হাতের নাগালে আনতে রেশম সিল্কের পরিবর্তে নাইলন ব্যাবহার হয়। 


মসলিন জামদানী বলে কি আদৌ কিছু আছে?

আর হ্যা রেশম জামদানী বলতে আসলে ফুল সিল্ক জামদানী বোঝায় 😛 বাট ফুল সিল্ক জামদানী খুব কম করা হয়, কারন সেটা এতটাই পাতলা আর ট্রান্সপারেন্ট হয়। যা দেখতে অনেক টা মসলিনের মত লাগে। বাট ফুল সিল্ক জামদানি মসলিন জামদানি না। কারন মনে রাখতে হবে মসলিনের প্রধান ভিত্তি হলো কটন। ফুটি কার্পাস জাত তুলা থেকে উৎপাদিত সুতা। 
মসলিন জামদানী যদি বলতেই হয় কোন কিছুকে সেটা ৩০০ কাউন্টের জামদানী গুলোকেই বলা উচিত। 
পারতঃপক্ষে মসলিন জামদানি বলে এখন বাজারে যেসব পাওয়া যায় তার কোনটাই মসলিন জামদানী নয়। এটা পুরোটাই তাতীদের মুখে প্রচলিত একটা শব্দ। অত্যন্ত হাল্কা ও সুক্ষ সুতার চকচকে জরি সুতার কাজের জামদানী গুলোকেই আজকাল মসলিন জামদানী বলা হয়। এসব জামদানীর কাউন্ট ৮৪/১০০ কাউন্টেরই হয়ে থাকে। 
আমরা যদি উৎসের দিক দিয়ে চিন্তা করি। ফুটি কার্পাস তুলার সুতা দিয়ে তৈরী হতো মসলিন। অর্থাৎ মসলিন এর উৎস হলো কটন। সিল্ক না। বর্তমানে রাজশাহী সিল্ক এর যে মসলিন পাওয়া যায় -তা ঢাকাই মসলিনের অংশ নয়। মসলিনের একটি জাত হলো জামদানী। মসলিন ৫০০/৭০০ কাউন্টের মতো হতো। জামদানী হতো ৩০০ কাউন্টের। আর এই কটন জামদানীর প্রচলন ছিলো আঠারোশ শতক পর্যন্ত! এরপর উনিশ শতকে সিল্ক সুতা কটন সুতার মিশ্রন শুরু হয়। সে হিসাবে মসলিন জামদানী বলতে ৩০০ কাউন্ট কিংবা ৫০০ কাউন্টের মসলিনে জামদানী নকশা কেই মসলিন জামদানী বলা যুক্তিসঙ্গত!

কাউন্ট কি?

সুতার কাউন্ট দিয়ে একটি সুতা কতটুকু মোটা বা চিকন তা বোঝানো হয়। কাউন্ট দুই ধরনের হতে পারে- ডিরেক্ট এবং ইনডিরেক্ট কাউন্ট। 
ডিরেক্ট কাউন্টঃ
জামদানীর তাতে আড়াআড়ি ভাবে চিরুনীর মত লম্বা একটা অংশ থাকে। একে বলে সানা। সেই সানাতে মেজার মেন্ট টেপ দিয়ে প্রতি ১ সেন্টিমিটারে লম্বা লম্বি ভাবে যে কয়টা সুতা যায়। অর্থাৎ এই যে ৮০/৮৪/১০০ কাউন্ট বলি- এই প্রতি ১ সেন্টি মিটারে লম্বালম্বি ভাবে ৮০ টা ৮৪ টা কিংবা ১০০ টা সুতা দেয়া থাকে। তাহলে ভাবেন তো ১ সে.মি ৩০০ কাউন্ট মানে সেটা কত সুক্ষ্ণ??? 
ইনডিরেক্ট কাউন্টঃ 
ইনডিরেক্ট কাউন্টে সংখ্যাটা যত বড় হয়, সুতা তত চিকন। প্রাকৃতিক আঁশ থেকে তৈরি সুতার জন্য ব্যবহার করা হয় ইনডিরেক্ট কাউন্ট। যেহেতু আমাদের মসলিন কাপড়ের সুতা তৈরি হয় ফুটি কার্পাস থেকে যা প্রাকৃতিক, তাই এর কাউন্টের হিসাব হয় এ পদ্ধতিতে। এ কাউন্টের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হল ইংলিশ কাউন্ট। ইংলিশ কাউন্ট অনুযায়ী আমরা হিসাব করি এক পাউন্ডে কত হ্যাংক সুতা আছে। এক হ্যাংক মানে হচ্ছে ৮৪০ গজ। তো ৫০০ কাউন্টের মানে হলো এক পাউন্ড সুতার দৈর্ঘ্য ৫০০ হ্যাংক অর্থাৎ ৫০০ গুণ ৮৪০ গজ বা ৪,২০,০০০ গজ সুতা আছে! অর্থাৎ, ৫০০ কাউন্টের মসলিন সুতার ক্ষেত্রে মাত্র এক পাউন্ড বা প্রায় আধা কেজি সুতার দৈর্ঘ্য হবে ৪,২০,০০০ গজ! তুলনা করলে বলা যায় এক পাউন্ড মসলিন সুতার দৈর্ঘ্য ৪৩টি এভারেস্টের সমান!
জামদানী কি সাধেই এত দাম বেশি??? 

ছবিতে যে জামদানী টা দেখছেন এটা আমার তাতীর করা একটা ফুল সিল্ক জামদানী। যার আড়ায়াড়ি লম্বালম্বি সব সুতাই সিল্ক। এটা কতটা পাতলা আর ট্রান্সপারেন্ট দেখেন। এতটা পাতলা আর নরম হাল্কা ওজনে যা দেখতে মসলিনের মত লাগে। বাট এটা কিন্ত মসলিন না। এটা ফুল সিল্ক জামদানি।
এটা একটা স্পেশাল অর্ডার করা শাড়ি। 

ফুল সিল্ক হলে জিনিস টা কত টা ভয়াবহ সুন্দর হয়!! ছবির শাড়ি টা মাত্র ১টা অংশ। এত টাই হাল্কা আর ট্রান্সপারেন্ট দেখতে মসলিনের মতই লাগে! যদিও এর আড়া আড়ি আর লম্বা লম্বি দুই দিকেই সিল্ক সুতায় বোনা। কত টা ট্রান্সপারেন্ট!!

সুত্রঃ ২০১৬ তে প্রকাশিত জামদানী শাড়ি কে GI act এ অন্তর্ভুক্তির জার্নাল, প্রথম আলোবাংলা ট্রিবিউন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *